নগরকেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা ও কতিপয় প্রস্তাবনা
শিক্ষায় বিনিয়োগ একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ। উচ্চমানের শিক্ষক দ্বারাই এই বিনিয়োগের অর্থবহ ফলাফল আনা সম্ভব। বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে অন্যতম অগ্রাধিকার খাত হিসাবে বিবেচনা করে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সহ নানাবিধ উন্নয়ন সাধন করছেন। এর পরেও শহরাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে শিল্পাঞ্চলগুলোতে শিক্ষার কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আজ সেই প্রতিবন্ধকতা ও তা হতে পরিত্রাণের কিছু বিষয় আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করছি।প্রতিবন্ধকতা সমূহ:
১/ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত: অধিক জনগোষ্ঠীর আওতায় থাকায় শিল্পাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে তুলনামূলক অধিক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত বেশী হওয়ায় কাঙ্খিত মান অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।
২/ অনগ্রসর জনগোষ্ঠী: শিল্পাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হতে আসায় তারা লেখাপড়ার প্রকৃত গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না । শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করল কী না, বিদ্যালয়ে গেল কী না, বিদ্যালয়ে খেয়ে আসল কী না, সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে আগমণ-প্রস্থান করল কী না অভিভাবকবৃন্দ এসব বিষয়ে খোঁজ নেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন না।
৩/ সহায়ক- সামগ্রী সম্পর্কে অসচেনতা: লেখাপড়া সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে নেওয়ার জন্য সময়-জ্ঞান; আনুষঙ্গিক খাতা, কলম; স্কুল-ড্রেস সঠিক সময়ে সরবরাহে সচেতন নন।
৪/ নিজ দ্বায়িত্ব আন্তরিকতার সাথে পালন না করা: শিক্ষক ও অভিভাবক উভয়ই শিক্ষার্থীদের প্রতি সঠিকভাবে দিক নির্দেশনা দিই না। পেশাগত দায়িত্ব ছাড়াও তাদেরকে বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় বুনিয়াদি শিক্ষাপ্রদানে আগ্রহ দেখাই না।
৫/ নৈতিক ও আচরণগত শিক্ষার অভাব: শিক্ষার্থীরা তাদের নিজ নিজ পরিবারের লোকজনের আচরণের প্রভাব বহন করে। যেহেতু সংশ্লিষ্ট অভিভাবকরা কর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন এবং সন্তানদের সময় দিতে পারেন না বিধায় তারা বিপথগামী হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। আবার আচরণগত বিষয়েও সঠিক শিক্ষা, বিদ্যালয় হতে দেওয়ার সুযোগ কম থাকে। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতার ঘাটতি ও আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়।
৬/ যোগ্য শিক্ষকের অপ্রতুলতাঃ শিক্ষকদের মাঝে নৈতিকতার মানের অভাব, রাজনীতিকরণ, আন্তরিকতার অভাব, পাঠদানের সংশ্লিষ্ট উপকরণ ব্যবহারে অনীহা এসব কারণও রয়েছে প্রতিবন্ধকতার কাতারে।
৭/ দারিদ্রতা: শিল্পাঞ্চল এলাকাতে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী লোকের আধিক্য থাকায় এই পরিবারসমূহের সন্তানেরাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। স্বাভাবিকভাবেই এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া শেখাতে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
৮/ এস.এম.সি.’র দৌরাত্ন: শিক্ষার মানোয়ন্নে কমিটির দায়িত্ব থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। লেখাপড়ার উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত সংরক্ষণে কমিটির ভূমিকা পালন করার কথা থাকলেও বাস্তবে রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়।
৯/ বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক না থাকায় একই শিক্ষককে বিভিন্ন বিষয় নিতে হয়, বিধায় একই শিক্ষকের পক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠা সম্ভব হয় না।
১০/ক্লাস সময়ের দীর্ঘসূত্রীতাঃ কোমলমতি শিশুদের দীর্ঘক্ষণ বিদ্যালয়ে ধরে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য। এছাড়াও ৬০% মহিলা শিক্ষক হওয়ায় আগমণ ও প্রস্থানের ব্যাপারে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করে।
১১/ কাজের পরিসর বৃদ্ধিঃ প্রাথমিক শিক্ষায় কাজের পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিক্ষাবান্ধব নয়। স্কুলের সময়ের ভেতরে বিভিন্ন ধরণের দাপ্তরিক কাজ, উপবৃত্তির কাজ, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজ, স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের কাজ করতে হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে মানসম্মত পাঠদান সম্ভব হয়ে ওঠে না।
প্রস্তাবনা:
১/ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নেমে আনা;
২/ অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে লেখাপড়ার উন্নয়নে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করা;
৩/ যথাসময়ে শিক্ষাসামগ্রী শিক্ষার্থীদের মাঝে সরবরাহ করা;
৪/ শিক্ষকদের নিজ দায়িত্ব, আন্তরিকতার সাথে পালনের জন্য উদ্বুদ্ধ ও ইতিবাচক মনিটরিং করা;
৫/ শ্রেণিকক্ষে নৈতিকতা ও আচরণিক অভ্যাসের চর্চা করা;
৬/ অধিকতর যোগ্য ও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়োগ দেওয়া;
৭/ দারিদ্রশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা;
৮/ ক্লাসের সময়সীমা শিশুবান্ধব করা;
৯/ শিক্ষকদের শুধুমাত্র পাঠদানের মধ্যে নিয়োজিত রাখা।
১০/ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদকে, বিদ্যালয়ের উন্নয়নে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত করতে নীতিমালা গ্রহণ করা।
লেখক: মোঃ আব্দুস সবুর খান, প্রধান শিক্ষক,
মরকুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, টঙ্গী, গাজীপুর।[email protected]