নিজস্ব,প্রতিবেদক
বর্তমানে দেশের বেশ ট্রেন্ডিং এক হট টপিক হচ্ছে রাসেলস ভাইপার। এতোটাই হট টপিক যে কেউ পোস্টের উপর রাসেলস ভাইপার লিখে দিলেই পোস্ট ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু পোস্ট সহো বিভ্রান্তিমূলক তথ্য সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ায় সকলে বেশ বিভ্রান্ত এবং জনগণের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে রাতে ঘুমাতে পারছে না কখন না জানি রাসেলস ভাইপার এসে কামড় বসায়। তার মধ্যে কারো শেয়ার করা একটি ছবিও দেখা যায় যেখানে দেখা যাচ্ছে চট্টগ্রামের সাপটির বেশ প্রাদুর্ভাব দেখা রয়েছে।
আজ এইসব ভুল ভ্রান্তি থেকে সম্পূর্ন চট্টগ্রামের লোকজন সহ পুরো দেশকে একদম শতভাগ সঠিক তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
➡️পয়েন্ট ১: ভাইরাল সেই পোস্টে বলা হয়েছে রাসেলস ভাইপারের কোন এন্টিভেনম নেই।
উত্তর: এটি সম্পূর্ণ ভুল এবং অজ্ঞতাপূর্ন কথা। আমাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এ সাপে কাটার চিকিৎসা বেশ উন্নতমানের।। দেশীয় প্রত্যেক সাপের বিষের ব্যাবহার হয় এমন এন্টিভেনম এখানে রয়েছে যার নাম পলিভ্যালেন্ট এন্টিভেনম। চট্টগ্রাম মেডিক্যালের ৩য় তলার ১৬ নং ওয়ার্ডে সাপে কাটার চিকিৎসা হয় সম্পূর্ন বিনা খরচে। এবং দেশের কয়েকটি সদর হাসপাতালে ছাড়া সব হাসপাতালে এন্টিভেনম মজুদ আছে
➡️পয়েন্ট ২: সব সাপের বিষ ১ রকমের। রাসেলস ভাইপার এর বিষ ৫-৬ প্রজাতির?
উত্তরঃ নাহ। কোন সাপের বিষই একই উপাদানের হয় না।। বিভিন্ন ভেনম/টক্সিক উপাদানের মিশ্রন থাকে।। যেমন: নিউরোটক্সিন+সাইটোটক্সিন, বা নিউরোটক্সন+আইসোটক্সিন, বা নিউরো+মাইটোটক্সিন এরকম মিশ্রিত থাকে।। রাসেলসের বিষের প্রধান উপাদান হেমোটক্সিন।
➡️পয়েন্ট ৩: রাসেলস ভাইপার তেড়ে এসে কামড়ায়?এটি বিশ্বের ১ নং আক্রমনাত্মক সাপ?আবার বিশ্বের ৫ম বিষধর সাপ?
উত্তর : নাহ। এটিও ভুল। রাসেলস ভাইপার কেনো,বিশ্বের সব থেকে আক্রমনাত্মক সাপ ব্ল্যাক মাম্বার ও তেড়ে এসে কামড়ে দেওয়ার রেকর্ড বিরল। সেখানে রাসেলস ভাইপার তো শিশু। বিশ্বের টপ ২০ টা বিষধর সাপের লিস্ট করলে সেখানে রাসেলস ২০ এও থাকবে না।। এমনকি বাংলাদেশের টপ ৫ এও এই সাপের অবস্থান নেই। বাংলাদেশের টপ ৫টি বিষধর সাপের লিস্ট
১. ইয়েলো বেলীড সী স্নেক
২. হুক নোজড সী স্নেক
৩,৪,৫,৬,৭,৮ নম্বর পজিশন নিয়ে বেশ তর্ক আছে।। তবে এটা সিউর যে এও ৩,৪,৫,৬,৭,৮ এই পজিশনে আমাদের দেশীয় ৫ জাতের কালাচ এবং কিং কোবরা বসবে। এরপরেই আসবে দুই গোখরা/ট্রু-কোবরা প্রজাতির সাপ। তারপরেই আসবে রাসেলস ভাইপারের নাম।
➡️পয়েন্ট ৪: এটির রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তর বিষদাঁত?আবার এটি কামড়ালে কোন দাগ বসে না? রাসেলস ভাইপার ঘুমন্ত অবস্থায় কামড়ায়?
উত্তর: কী উত্তর দেবো এই প্রশ্নের? যদি এত বড়ই বিষঁদাত হয়ে থাকে,তবে কেনো দাগ বসবে না? আমাদের তো পিপড়ের হুল ফোটালেও দাগ দেখা যায়। দাঁতের দাগ থাকে না কালাচ প্রজাতির সাপেদের।। রাসেলস এর না।। আবার ঘুমন্ত অবস্থায়ও কামড়ায় কালাচ প্রজাতির সাপেরা।। রাসেলস না।।
➡️পয়েন্ট ৫: এরা ৫০-৮০ টা বাচ্চা জন্ম দেয়?
উত্তর: ভুল কথা।। এরা সর্বোচ্চ ২০-৪০ টা বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। তবে সর্বোচ্চ একটিই রেকর্ড আছে ৭৫ টির।। সাধারনত এই সংখ্যা ২০-৪০ই হয়।
চলুন, ২য় ছবিতে রেফারেন্স সহ দিয়ে দেবো এরা আসলে কতোটা বাচ্চা দেয়। আবার এদের অর্ধেক বাচ্চাই প্রকৃতিতে টিকে থাকে না।।মারা যায়।। সেটা প্রত্যেক সাপের বাচ্চার ক্ষেত্রেই।। তার উপর সর্প খাদক সাপ/ঈগল/বেজী তো আছেই।
তবে এখানে এক্টা কথা। উপরের ৩টি প্রানীর নাম মেনশন করেছি এদের অস্তিত্ব হুমকীর মুখে।। যার কারনে রাসেলস ভাইপারের অস্তিত্ব বৃদ্ধির পথে।। এটা মনে রাখবেন। এরা কমে গেছে বিধায় রাসেলস ভাইপার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
➡️পয়েন্ট ৬: বাংলাদেশের ইকোলজি তে এদের কোন ভূমিকা নেই?
ইতোপূর্বে যত প্রানী এই দেশে ছিলো যত প্রানী এখন নেই তাদের বিরুপ প্রভাব আমরা দেখতেই পাচ্ছি। একটা উদাহরন দেই, অতিমাত্রায় নির্বিষ কৃষকের বন্ধু দাড়াশ মা'রার কারনে বর্তমানে ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব মাত্রাতিরিক্ত। ইকোলজি তে প্রত্যেকটা প্রানীরই সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।। প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায় আলাদা ভূমিকা রাখে।। তাছাড়া রাসেলস ভাইপারের ভেনম হেমোটক্সিন। এই হেমোটক্সিন বিষ ব্যাবহার করে বিভিন্ন প্রানরক্ষাকারী ঔষধ তৈরী করা হয়।।এছাড়াও,রাসেলস ভাইপারের এন্টিভেনম হিউজ পরিমানে বানাতে গেলে অবশ্যই হিউজ এমাউন্ট ভেনম ও দরকার হবে। আমাদের দেশে এখনো সেইভাবে ভেনম কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়নি বিধায় আমরা অজ্ঞ।। তবে চট্যগ্রাম ভেনম রিসার্চ সেন্টারের বিশেষজ্ঞদের মারফত জানতে পারি শীঘ্রই বিষকে কাজে লাগিয়ে এন্টিভেনম উৎপাদন সহ বিষকে মানব উপকারী কাজে লাগানোর মতো কার্যক্রম তারা ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের দেশেও এন্টিভেনম উৎপাদন হবে ইন শা আল্লাহ।
এবার জেনে নেওয়া যাক রাসেলস ভাইপারের প্রতিরোধ বা প্রতিকার, কামড়ালে কী করবো? কী করবো না এসব নিয়ে।
➡️প্রতিরোধ : এটার কোন প্রতিরোধ চট্টগ্রামের মানুষের করার প্রয়োজন আপাতত নেই। কারন লাস্ট বহু বছরে এই সাপের কোন রেকর্ড এই অঞ্চলে নেই। ২০১৭/১৯ সালে একটা ভিডিওতে গুলিয়াখালীতে এও সাপের ভিডিও দেখেছি যেটা ছিলো নদী থেকে সমুদ্র হয়ে ভেসে আসা একটা সাপ। তাও ওই সাপের পরবর্তীতে কী হয়েছে তা কেউই জানে না। এর মধ্যে শেষ ৫ বছরেও কোন রেকর্ড এই সাপের নেই।। যদি কারো কাছে অথেন্টিক কোন ডকুমেন্টস থাকে প্লিজ ফিল ফ্রি টু শেয়ার।
তবে যদি প্রতিকার করতেই চান, বেশী বেশী করে বেজী,কিং কোবরা (৪র্থ ছবি), এবং শঙ্খিনী সাপ (৩য় ছবি) নিধন থেকে বিরত থাকবেন। কারন শংখীনী সাপ এর প্রধান খাবার হচ্ছে অন্য সাপ।এমনকি এটি তার স্বজাতির কালাচ সাপকেও এটি খেয়ে থাকে।। আর এই সাপ বিষধর হওয়া সত্ত্বেও এটি কাম্রানোর রেকর্ড একদমই হাতে গোনা। এরা কামড়ায় না সহজে। বরং ভয় পেলে মাথা লুকিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ফেলে।। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বেশ পরিচিত এই সাপ যার বিভিন্ন আঞ্চলিক নামে পরিচিত (আনাই/আনি/হানি/দুমুখো সাপ)।
প্রকৃতির কোন প্রানীকেই আসলে অযথা নিধন করা উচিত না।। এতে এক্টির সংখ্যা কমে অপরটির বেড়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়।।
➡️কী করা যাবে এবং কী করবেন না?
যদি অদুর ভবিষ্যতে রাসেলস ভাইপার সাপ আসেও, যদি কামড় দেয়, যা করবেন না:
১. মোটেও সাপুড়ে/ওঝা/কবিরাজ/বৈদ্য/স্বপ্নের ফেরীওয়াল/তাবিজ বাবা খ্যাত ব্যাক্তিদের কাছে যাওয়া যাবে না।
২. কামড়ের স্থানে ব্লেড ছুড়ি দিয়ে কাটাকাটি করা,মুখ দিয়ে শুষে রক্ত বের করা এসব করা যাবে না।।
৩. কোন প্রকার বাঁধ,গিট্টুই দেওয়া যাবে না বিশেষ করে ভাইপার নাম ধারী সাপেদের ক্ষেত্রে। কারন এতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে অঙ্গহানী ঘটবে পরে হাত/পা/কামড়ের স্থান কেটে বাদ দিতে হবে।
৪. মুখে মরিচ নিয়ে ঝাল লাগা না লাগা পরীক্ষা করা যাবে না।
৫. সাপে কাটা রোগীর সামনে "ওহ মাগো,ওহ আল্লাহ আমার ছেলের কি হবে,ও আল্লাহ আমার ভাই কে তো সাপে কামড়ে দিলো, এসব চিল্লাফাল্লা করে রোগীর মনে আতংক তৈরী করা যাবে না। আপনি যত বেশী রোগীকে আতংকত করবেন, তার তত বেশী হার্ট পাম্পিং করতে থাকবে।।রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পেয়ে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। অথবা, ভয়ে রোগী হার্ট এটাক করে সাপের বিষের আগেই মা'রা যেতে পারে।
➡️যা করবেন:
১. রোগীকে অভয় দিবেন সাহস যোগাবেন।
২. যেখানে কামড়েছে সেই অঙ্গ কম নাড়াচাড়ার চেষ্টা করবেন
৩. রোগীকে ১ ঘন্টা ৪০ মিনিটের মধ্যেই হাসপাতালে নিলে রোগী বাঁচার সম্ভাবনা ১০০%। যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
৪. রাসেলস ভাইপার আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হলেও নিয়মিত ডাক্তারী চেকাপ এ রাখতে হবে।
পরিশেষে এটাই বলবো কোন ভাবেই আতংকিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। মনে রাখবেন ভয়কে জয় করা জরুরী। মাথা কাটা কখনোই মাথা ব্যাথার সমাধান নয়। বরং সমস্যার গোড়ায় কি আছে তাকে উপড়ে ফেলাই প্রয়োজন।
শেয়ার দিয়ে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন।
সম্পাদকঃ মোঃ আব্দুল বারী।
© ভোরের কন্ঠ - ২০২৪