নিজস্ব প্রতিবেদক,
সারাদেশে যে সরীসৃপ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে তার নাম রাসেল ভাইপার। রাসেল ভাইপার পৃথিবীর অন্যতম বিষধর সাপ। এদেশের মানুষের কাছে এটি চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া নামেই বেশি পরিচিত। সম্প্রতি দেশের কয়েকটি স্থানে এই বিষধর সাপের উপদ্রব বেড়েছে। এর কামড়ে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এক সময়ের বিলুপ্ত বিষাক্ত সাপ রাসেল ভাইপার ধীরে ধীরে রাজত্ব করতে শুরু করেছে দেশটিতে। বরেন্দ্র এলাকা ছাড়াও বরিশাল, পটুয়াখালী, চাঁদপুর এমনকি ঢাকার আশপাশেও সাপ দেখা যায়। এ বছর সাপের কামড়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সাধারণত, সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলে, কিন্তু রাসেলের ভাইপারের বিপরীত আচরণ। নিজেকে বিপন্ন মনে করলেই করে বসে আক্রমণ। আক্রমণের ক্ষেত্রে এটি এত ক্ষিপ্র যে, ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ে শেষ করতে পারে পুরো প্রক্রিয়া। ক্ষেপে গেলে শব্দ করে প্রচণ্ড জোরে। ঠিক যেন প্রেসার কুকারের মতো।
রাসেল ভাইপারের বিষ হেমাটোটক্সিক, যার ফলে আক্রান্ত স্থানে ফুসকুড়ি হয়। ক্ষতটি এক্সপোজারের পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফুলে যায়। এর বিষ ফুসফুস, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গকে ধ্বংস করতে পারে।
বেশিরভাগ সাপ ডিম পাড়ে, রাসেল ভাইপার বাচ্চাদের জন্ম দেয়। মহিলা রাসেল ভাইপার সাধারণত গর্ভাবস্থার শেষে ২০ থেকে ৪০ টি বাচ্চার জন্ম দেয়। তবে 80টি বাচ্চা দেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। একদিকে উচ্চ প্রজনন ক্ষমতার কারণে, অন্যদিকে বিজি, গুসাপসহ সাপের প্রাকৃতিক শত্রু নিখোঁজ হওয়ার পাশাপাশি ইঁদুর, ব্যাঙ, রাসেল ভাইপারসহ সাপের পর্যাপ্ত খাবারের উপস্থিতি। বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কতটা ভয়ঙ্কর এই রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ? কামড় দিলেই কি মৃত্যু নিশ্চিত? বাংলাদেশে অল্প যে কয়েকটি সাপ অত্যন্ত বিষধর, তার মধ্যে একটি হলো রাসেল ভাইপার। বৈজ্ঞানিক নাম ডাবোয়ইয়া রাসেলি, যা ভাইপারিডি গোত্রের একটি ভয়ঙ্কর বিষাক্ত সাপ। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এ সাপ বেশি দেখা যায় এবং এটি ভারতের সবচেয়ে বড় চারটি সাপের মধ্যে একটি।
রাসেল ভাইবার সাপের দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু হয়ে থাকে। মাথা চ্যাপ্টা ত্রিকোণাকার। মাথার তুলনায় ঘাড় অনেকটাই সরু। শরীরের রঙ বাদামি, হলদে বাদামি অর্থাৎ কাঠ রঙের হওয়ায় শুকনো পাতার মধ্যে এই সাপ নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। সাপটির জিহ্বার রঙ বাদামি বা কালো। সারা গায়ে স্পষ্ট বড়ো গাঢ় বাদামি গোলগোল দাগ থাকে, এই দাগগুলোর মাথা ছুঁচালো।
অনেকসময় দাগগুলো এক সঙ্গে দেখতে শিকলের মতো লাগে। গোলাকার দাগগুলো দেখতে অনেকটাই চাঁদের মতো। দাগগুলোর চারপাশে কালো রঙের বর্ডার থাকে, তার মধ্যে সাদা বা হলুদের ছিটে লক্ষ্য করা যায়। পেটের দিকের আঁশ এর রঙ সাদা। এদের বিষদাঁত লম্বা। বিষদাঁতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫-১৬ মিমি পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার বিষদাঁত পৃথিবীতে দ্বিতীয় সবচেয়ে বৃহৎ দাঁত।
বিভিন্ন মেডিকেল জার্নাল অনুসারে, গোখরো সাপের কামড়ের গড়ে আট ঘণ্টা পর, কোয়োট সাপের কামড়ের গড়ে ১৮ ঘণ্টা পর এবং কামড়ের পর গড়ে ৭২ ঘণ্টা বা তিন দিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে। চন্দ্রবোড়া বা রাসেলের ভাইপার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, যদি এই সময়ের মধ্যে অ্যান্টিভেনম পরিচালনা করা যায়, জীবন বা অঙ্গ বাঁচানো যেতে পারে।
বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মো. আবু সাঈদ গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের সব অঞ্চলে শিয়াল, গুইসাপ ও বেজি দেখলেই লোকজন মেরে ফেলছেন। তারা জানেন না, এটির উপকারিতা কত! এ কারণেই রাসেল ভাইপারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কারণ তার খাদক নেই। ইকো সিস্টেমে ব্রেক হয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, সাপ দংশন করলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া উচিত। ওঝার বাড়িতে গিয়ে অনেকে সময় নষ্ট করেন। এতে বিষক্রিয়া পুরোপুরি প্রকাশ পেয়ে গেলে আইসিইউ সাপোর্ট ছাড়া রোগীকে বাঁচানো যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, অ্যান্টিভেনম উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত দেয়া আছে। যেসব এলাকায় সাপের উপদ্রব বেশি, সেসব জায়গায় সংরক্ষিত আছে। এনসিডির (নন কমিউনিকেবল ডিজিজ) সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেটি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৫,৮০,০০০ হাজার মানুষকে সাপে কামড়ে এবং তাদের মধ্যে ৬০০০ মৃত্যু হয়।
সম্পাদকঃ মোঃ আব্দুল বারী।
© ভোরের কন্ঠ - ২০২৪